Thursday, March 11, 2021

সম্পদের ঔদ্ধত্য এবং আমরা


আমি যদি ফিদেল কাস্ত্রোর মেয়ের নাম- ঠিকানা জানতাম তাহলে তাকে চিঠি লিখে বলতাম, "তুমিই ভুল, তোমার বাবাই ঠিক ছিল"।
আমি ব্যক্তিগতভাবে অবাধ ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার পক্ষে হলেও সমাজতন্ত্রের মতো একটি বদ্ধ ব্যবস্থার গুণগান কেনো গাইছি তা এই লেখায় ব্যাখ্যা করবো।

যে আমেরিকা ৬৩৮ বার ফিদেল কাস্ত্রোকে মারার ব্যর্থ চেষ্টা চালায় ফিদেল কাস্ত্রোর মেয়ে বাবার উপর অভিমান করে দেশ ছেড়ে সেই আমেরিকাতে গিয়ে বসবাস করছে, সে ধনতন্ত্রের সমর্থক, অবাক ব্যক্তিস্বাধীনতার সমর্থক। কিন্তু আমরা বিশ্বের অধিকাংশ দেশে এই কাল্পনিক অবাধ ব্যক্তিস্বাধীনতার স্বাদ কতটা পাচ্ছি তাই এখন দেখার বিষয়। আসুন দেখে নিই আমরা সেই অবাধ ব্যক্তিস্বাধীনতার সুখ কতটা পাচ্ছি!

অবাধ ব্যক্তিস্বাধীনতা বলতে বুঝায় গণতন্ত্র। উন্নত বিশ্বের গণতন্ত্র সফল, কিন্তু অনুন্নত বিশ্বে গণতন্ত্র এক মেরুদণ্ডহীন স্বপ্নের নাম; যে স্বপ্নের শুরু জন্মের পরে আর মৃত্যুর পূর্বেও তার স্পর্শ লাভ করার সৌভাগ্য আমাদের হয় না।

অনুন্নত বিশ্বে গণতন্ত্র সর্বসাধারণের স্বাধীনতা নয় বরং পরিণত হয়েছে মুষ্টিমেয় অভিজাত শ্রেণির অতি অবাধ স্বাধীনতা লাভের হাতিয়ারে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বত্র উদ্ভব হয়েছে কতৃত্ববাদের। আর শুধু এই কতৃত্ববাদীরাই লাভ করছে সেই অবাধ মুক্ত ব্যক্তিস্বাধীনতা। আর বাকিরা পরিণত হয়েছে তাদের পীড়নের শিকারে।

অনুন্নত বিশ্বের ব্যর্থ গণতন্ত্র আমাদেরকে জাতীয় জীবনে উপহার দিয়েছে আইনশৃঙ্খলার দুর্গতি ও বিচারহীনতা। ফলে নিরাপত্তার শঙ্কা এবং মতামত প্রকাশের ও অন্যয়ের প্রতিবাদের ক্ষেত্রেও হামলার ভয়। প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে হারিয়ে গেছে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। তাহলে আর সুস্থ নাগরিক জীবনের কোন জিনিসটা বাকি থাকলো?

অনুন্নত বিশ্বে যেখানে আমার ব্যক্তিসম্মান নাই, জানমালের নিরাপত্তা নাই, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা নাই, সুবিচার পাওয়ার নিশ্চয়তা নাই সেখানে কাল্পনিক ব্যক্তিস্বাধীনতা দিয়ে আমি কী করবো?

সমাজতন্ত্রের দেশগুলোতে বেকারত্বের সমস্যা থাকেনা। তারা বেকার সমস্যা সমাধানে কী ধরনের পদ্ধতি গ্রহণ করে থাকে তা চীন, রাশিয়া, কিউবার ইতিহাস পড়লে বুঝতে পারবেন। তাই তাদের তরুণ প্রজন্মের সম্ভাবনাময় সময়টা আনপ্রডাক্টিভ কাজে ব্যয় হয় না, সেটার সদ্ব্যবহার হয়। আর অনুন্নত বিশ্বের ব্যর্থ গণতন্ত্রের দেশে নিয়োগ বোর্ড ও সরকারি কোষাগার বেকারদের রক্ত চুষে জোঁকের মতো ফুলে ফেপে উঠে। তরুণদের সম্ভাবনাময় সময়টা ব্যয় হয় বেকারত্ব নামক হতাশায়।

এসব তো গেলো বড় পরিসরের কথা। এখন আরেকটু গভীরে ঢুকি, পরিবারে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারী হওয়ায় ক্ষমতায় পরিবারের কর্তা কতৃত্ববাদী হয়ে উঠে পরিবারের অন্য সদস্যদের উপর; হয় নারী নির্যাতন ও শিশু নির্যাতন অধিকন্তু শিশুদের উপর মানসিক নির্যাতন।
ব্যক্তিগত সম্পত্তি মানুষকে পাশবিক করে তোলে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির কারণে পাওয়ারফুল হয়ে স্বামী স্ত্রীকে নির্যাতন করে, বাবা-মা সন্তানকে নির্যাতন করে। আমি মোটেও গাঁজাখুরি কথা বলছি না, নিজ চোখে দেখা বাস্তবতা তুলে ধরছি।

এবার এর সামাজিক প্রভাব সম্পর্কে বলি। এর ফলে সমাজের বিত্তশালীরা কতৃত্ববাদী ও চড়াও হয়ে উঠে সমাজের সাধারণের উপর। বিষয়টা বুঝানোর জন্য প্রথমেই একটা গল্প বলে নিই-
আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসতাম। মেয়েটার পরিবার বিদেশে (মধ্যপ্রাচ্যে) ওডজব করে অনেক টাকার মালিক হয়। ফলে তারা বিনয়ী হওয়ার পরিবর্তে কতৃত্ববাদী হয়ে উঠে। সেই সময়ে তারা এক পয়সাওয়ালা বরের সন্ধান পায় ও যেও মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করে ধনী হয়েছিল। তার সাথেই মেয়েটার বিয়ে হয়। তারা জানতো ছেলেটা এইচএসসি পাশ, কিন্তু ঘটক ঘুষ খেয়েছিল। ছেলেটা কোনো পড়াশুনাই করেনি। অন্যদিকে মেয়েটা এইচএসসি পাশ করে ভর্তি প্রত্যাশী। ফলে বিয়েটা টেকেনি।
যাহোক ডিভোর্সের পরেও আমি মেয়েটাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। তখন মেয়েটার নানা আমাদের গ্রামে এসে কিছু লোকের কাছে আমাদের সম্পর্কে যাচ্ছেতাই বলে গেছে। আমি নাকি তাদের মেয়ের যোগ্যই নই। অথচ তাদের মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ফরম তোলার যোগ্যতাই অর্জন করতে পারেনি। আর আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়েও তার যোগ্য নই! আর একজন এইচএসসি পাশ করেই তার যোগ্য ছিল, কারণ তার টাকা ছিল।
আমার এক বন্ধু একবার আমাকে বলেছিল, "একটা বিষয় দেখো, তুমি ভালো না মন্দ সমাজে তা নির্ণয় করা হবে তোমার সম্পদ দিয়ে। মনে করো তুমি একটা পরিচিত লোককে তাদের মেয়েকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিলা তাহলে সেই লোকটা কী করবে জানো?
যদি তোমার সম্পদ না থাকে তাহলে সেই লোকটা অন্যদের কাছে বলে বেড়াবে, অমুকের ছেলেটাকে ভালো ভেবেছিলাম কিন্তু এ ভিতরে ভিতরে এত খারাপ ভাবতেও পারিনি...; আর যদি তোমার সম্পদ থাকে তাহলে বলবে, যাক বাহে পরিচিতর মাঝেই একজন ভালো ছেলে পেলাম, আর দূরে যাই কেনো? এখানেই বিয়েটা দেই।
তার মানে তুমি ভালো নাকি মন্দ তা ঠিক করা হচ্ছে তোমার সম্পদের উপর ভিত্তি করে, সততার উপর ভিত্তি করে নয়।"
এভাবেই ব্যক্তিগত সম্পত্তি মানুষের মানবিক বোধগুলোকে ধ্বংস করছে; মানুষ কতৃত্ববাদী ও অমানুষ হয়ে যাচ্ছে।

উচ্চমাধ্যমিকের বাংলা বইয়ে কোনো এক গল্পে একটা উক্তি পড়েছিলাম- "হাতে বন্দুক থাকলে নিরীহ মানুষেরও চোখ পড়ে পশুপাক্ষীর দিকে"। ঠিক তেমনি অনুন্নত বিশ্বে গণতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ উপহার ব্যক্তিগত সম্পত্তি মানুষকে কতৃত্ববাদী করে তোলে আর শুধু কতৃত্ববাদীরা সুবিধা ভোগ করে।

ফলে ব্যক্তির কেনো সম্পত্তি থাকবে? সম্পত্তি থাকবে রাষ্ট্রের ও রাষ্ট্র তার নাগরিকদের পারফরমেন্স অনুযায়ী তাকে আরও ভালো করার জন্য বোনাস ও সাপোর্ট দেবে। এতে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রতিষ্ঠিত হবে।

তবে এটা ঠিক যে, আমাদের এসব কথা শুধুই ভুতের বকুনি। আমাদের আবস্থা প্যারালাইজড হয়ে যাওয়া গরুর মতো। দেশে যতই উন্নয়ন উন্নয়ন গীতের ক্যাসেড বাজুক না কেনো নাগরিকদের মনে স্বস্তি না থাকলে এসব অর্থহীন।

© লেখক : মেহেদী হাসান।
বই : আই ডোন্ট কেয়ার (লেখা চলছে)।



লাইফের বিভিন্ন বিষয়ে উপদেশ-পরামর্শ পেতে লাইফ একাডেমির অ্যাডভইস ডেক্সে আসুন। আর Advice Desk এর ওয়েবসাইটের হোমপেজে যেতে এখানে—ক্লিক—করুন

সুন্দর জীবনের জন্য পরামর্শ | Advice Desk

No comments:

Post a Comment