আমার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী আমাকে বললেন আমি নাকি খুব উগ্র হয়ে গেছি। হ্যা, কথাটা সত্য; এটা স্বীকার করতে আমার সমস্যা নাই। তবে আমি যে একসময় খুবই শান্ত ও ভদ্র ছিলাম যেরকম শান্ত-ভদ্র ছেলে হাজারে একজন পাওয়া যায় সেইরকম একজন ছেলে ছিলাম একথা তিনি বিশ্বাস করলেন না।
তাহলে তো আমাকে বলতেই হয় কীভাবে আমি এতো শক্ত, উগ্র ও ইস্পাত কঠিন হয়ে গেলাম তার কিছু সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত। আর সেসব বলার আগে আমার শৈশব ও কৈশোরের নরম মন-মানসিকতার কিছু নমুনা তুলে ধরি। একবার কোনো একদিন বাবা আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে হাটে গেলেন। মাছের বাজারে নদীর কিছু দেশী মাছ বিক্রি হওয়া প্রায় শেষ, স্টকের শেষ মাছটুকু বাবা কিনলেন, অন্য একজন কিনতে এসে আর পেলেন না। আমার ইচ্ছে হলো মাছগুলো তাকে দিয়ে দেওয়া হোক, যেহেতু সে নিতে আশা করেছে। অথচ আমরা আগে নিয়েছি এবং এটাই আমাদের অধিকার— এই সত্য-সঙ্গত অধিকারের দম্ভ টুকুও আমার ছিল না; এতো নরম-কোমল মন নিয়ে ছিলাম।
কখনও যদি মানুষের আঘাতে পা ভেঙে যাওয়া কোনো কুকুর চোখে পড়তো সেই অবোলা প্রাণিটার কষ্টে দুঃখ পেয়ে কয়েকঘণ্টা মনমরা ও ব্যথিত হয়ে থাকতাম। কোনো পশুপাখি মরে পড়ে আছে কিংবা কোনো পাখি বৃষ্টিতে ভিজে কাঁপছে কিংবা আঘাত পেয়েছে দেখলে কী কষ্টটাই না পেতাম। কোনো পঙ্গু মানুষকে দেখলে তার কষ্টের দুঃখ কয়েকদিন ধরে আমাকে তাড়া করে বেড়াতো।
এককথায় মানুষ বা কোনো প্রাণির কোনো কষ্ট দেখলে খুব ব্যথিত হয়ে যেতাম।
এসব তো গেলো আমার কোমল মনের বিষয়বস্তুর কথা; এখন বলতে হয় আমার শৈশবের ভীরুতা সম্পর্কে। আমি যে কতটা ভিতুর ডিম এবং বোকা ও আত্নবোধহীন ছিলাম তা আপনারা কল্পনাও করতে পারবেন না। কেউ অন্যায়ভাবে আমাকে কিছু বললে বা কিছু করলে আমি তা মেনে নিতাম এবং সেটা যে অন্যায় করা হচ্ছে এবং এর যে প্রতিবাদ করা যায় তাও আমি বুঝতাম না।
সেইসাথে আমি শৈশবে আমার সমবয়সীদের অকাজের শাস্তির ভাগীদার হতাম। তাদের সাথে যখন ঘুরতে যেতাম তারা এটা সেটা অকাজ করতো; আমি তাদের সেসব থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে ব্যর্থ হতাম এবং তখন নিজে সৎ থাকতে আমি সেই কাজে অংশ না নিয়ে সেখান থেকে চলে আসতাম। অথচ উল্টো যখন সেই ক্ষতি যে ব্যক্তির হয়েছে সে যখন তাদের কাউকে ধরে বসতো তখন তারা আমার নামে দোষ চাপিয়ে বলতো যে আমি ওই কাজটা শুরু করেছি। এভাবে অন্যদের মন্দ কাজের দোষের ভাগী হতে হতো কোনো দোষ না করেই। আর আমার পরিবারের অভিভাবক আবার ওদের কথাই বিশ্বাস করে মহান বিচারক সেজে আমার শাস্তির ব্যবস্থা করতো। সাহস দেখিয়ে যে ওদের এই হীন কাজের শিক্ষা এদের দিবো সেই সাহস ও বুদ্ধিও পেতাম না। এভাবে তিক্ত অভিজ্ঞতা হতে থাকায় আমি অন্যান্য সমবয়সী কিশোরদের সাথে ঘোরাফেরা বন্ধ করে দেই। ফলে আমি সামাজিকীকরণে পিছিয়ে পড়ি এবং প্রবল অন্তর্মুখী হয়ে যাই।
আমি সবসময় সত্য কথা বলতাম এবং এখনও বলি। আমি সত্যবাদী ছিলাম কিন্তু সৎসাহসী ছিলাম না। যে কাজটা আমি করি নাই তবুও যদি একবারের বেশি বারবার কয়েকবার জিজ্ঞেস করতো যে আমি সেটা করেছি কি না? তখন এই বারবার করা একই প্রশ্ন সহ্য করতে না পেরে সেই কাজ না করেও স্বীকার করতাম যে আমি সেটা করেছি। কিন্তু এখন আর তা করি না। সত্য কথা একবার বলার পর আবার কেউ একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে এতো বেশি রেগে যাই যে পুনরায় এক কথা তোলার সাহস কেউ করে না।
আমার কঠিন হওয়ার শুরু সরলতার বিশ্বাস ভঙ্গ হওয়া থেকে। আমি খুবই সরল মনের মানুষ ছিলাম। কেউ কিছু বুঝালে সুবোধ বালকের মতো তা বুঝতাম। কিন্তু লাইফে বহুবার যখন দেখলাম যে সেসব কোনো ভালো বুঝ ছিল না, ছিল শুধু স্বার্থবাদীতার প্রয়োগ তখন থেকে সেসব লোককে শ্রদ্ধা সমীহ করা বন্ধ করতে শুরু করলাম।
এরপর আমার লাইফের চাওয়াপাওয়া ও প্রত্যাশাগুলোকে একে একে ধামাচাপা পড়তে দেখলাম। মানুষজাতি ও মানব সমাজের অনেক কপটতা, কুটিলতা ও বহুরূপতা দেখলাম। ছোটোবেলার জেনে আসা অনেক নীতিকথা ভুল প্রমাণিত হতে দেখলাম। উপরের সৌন্দর্য ও মধু'র ভিতরে কুৎসিত রূপ ও বিষ লুকিয়ে থাকা দেখলাম। দেখলাম প্রতিটি মানুষই লাইফে অন্যের কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করে কিন্তু নিজেকে অন্যের ক্ষেত্রে সেরূপ ডেডিকেটেড করে না বরং নিজে স্বার্থবাদ, সুবিধাবাদ এবং কতৃত্ত্ববাদ এই তিনটা জিনিসের চর্চা করে।
লাইফে অন্যের সহযোগিতা পাওয়ার পরিবর্তে পেলাম কুলুপবাজি, সমালোচনা এবং সান্ত্বনা।
সেইসাথে কোমল মনের চর্চা সাহিত্য পড়া বাদ দিয়ে কঠিন বাস্তবতার বিষয়বস্তু পড়া শুরু করলাম। তাই এখন আমি আর অন্যদের ভুংভাং কথা সুবোধ বালকের মতো মেনে নেই না বলে অভদ্র, উগ্র সাব্যস্ত হয়ে মানুষের সমালোচনার উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হলাম। অবশ্য এতে আমি ঘাবড়াই না।
এপিজে আবদুল কালাম বলেছিলেন, "সামনে দাঁড়িয়ে পথ দেখানোর কেউ নেই, পাশে দাঁড়িয়ে ভরসা দেওয়ার কেউ নেই, কিন্তু পেছনে দাঁড়িয়ে সমালোচনা করার লোকের অভাব নেই"।
ডেল কার্নেগী বলেছিলেন, "বাহিরে থেকে কারও সমালোচনা করা যতটা সহজ তার জায়গায় দাঁড়িয়ে তার পরিস্থিতি বোঝা ততটাই কঠিন"।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, "নিন্দা করতে গেলে বাইরে থেকে করা যায়, কিন্তু বিচার করতে গেলে ভেতরে প্রবেশ করতে হয়"।
আমি জানি বিচার করার মতো মানসিকতা অন্য জাতির থাকলেও বাঙালি জাতির নেই। সমালোচনা হলো বাঙালির একটি প্রিয় মুখরোচক খাবার।
বিশ্বের উন্নত দেশসমূহে সমালোচনা করার একটি নীতি আছে তা হলো একটা বিষয়ে ভালোভাবে জেনে তারপর তারা সমালোচনা করে, কিন্তু বাংলাদেশে এর উল্টো; এখানে সেই কয়েক অন্ধের হাতি দেখা গল্পের মতো বাঙালি কোনোকিছুর ১০% জেনেই তাতে কমেন্ট করে। সেসব দেশসমূহে সমালোচনা করতে যোগত্যা লাগে আর বাংলাদেশে কারো সমালোচনা করতে গেলে নিজের মুর্খতাই যথেষ্ট।
সেই শৈশবের বিনা অপরাধে দোষের ভাগী হওয়ার কথাগুলো আমার এখন কখনও কখনও মনে পড়লেও সেগুলো কোনো দুঃখ উৎপাদন করে না। কিন্তু তরুণ বয়সের কিছু নিরপরাধ দুর্ভোগ আমাকে বেশ কঠিন মানুষ বানিয়ে দিলো। সেসব আমি আমার অন্য একটা লেখায় লিখেছি। ইচ্ছে হয় অপরাধ না করেও যখন গত ১০ বছরে অনেকের করে যাওয়া অপরাধের শাস্তির ভাগ ভোগ করলাম তাহলে এখন সেই অগ্রিম শাস্তি গুলোর অপরাধ করে সেটা পুষিয়ে দেই।
হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, "মানুষ শুধু শুধুই কঠিন হয় না, অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা ও বর্তমানের পরিস্থিতি তাকে কঠিন হতে বাধ্য করে"।
আমি আমার লাইফে প্রথমে আমার স্বপ্নগুলোকে হারালাম, তারপর আমি আমার ভালোবাসাকে হারালাম এবং সর্বশেষ আমি একজন স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার মতো পরিবেশটাও হারালাম। তো আমি উগ্র হবো না তো কী হবো?
© লেখক : মেহেদী হাসান।
বই : আই ডোন্ট কেয়ার (লেখা চলছে)।
গিভ অ্যান্ড টেক | A book of self development
মুখবন্ধ
•••••••••
মাতৃস্নেহ অতুলনীয়, বাবার মতো বন্ধু কেউ নেই, পরিবার সবচেয়ে বড় আস্থার জায়গা হেন তেন— এইসব কথাবার্তা হলো ভুয়া এবং অতিরঞ্জিত কথাবার্তা। এই পৃথিবীতে কেউ কারো নয়, সবাই স্বার্থবাদী এবং সুবিধাবাদী— এই সত্যটা যে যত দ্রুত বুঝতে পারবে তার জন্য ততই মঙ্গল। এই পৃথিবীর সবাই চলে 'গিফ অ্যান্ড টেক' পলিসিতে; সবাই তোমার কাছে কিছু জিনিস প্রত্যাশা করে, আর সেই প্রত্যাশা নিয়েই তোমার উপর ইনভেস্ট করে। তুমি যদি সময়মতো সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে না পারো তাহলেই বুঝবে তোমার প্রতি ইনভেস্ট করাটা ভালোবাসার দান ছিল নাকি প্রত্যাশার ইনভেস্ট ছিল। তুমি প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হলে তোমাকে দোষারোপ করা হবে; তুমি কী কারণে পারো নাই তা কেউ বুঝতে চাইবে না; ভুল বোঝার জন্য অনেকে থাকে, কিন্তু পরিস্থিতি বোঝার জন্য কেউ থাকে না। নিজের একান্ত দুর্দিনে কাউকেই পাশে পাওয়া যায় না। বাবা-মা, অমুক মামা, অমুক খালু, অমুক আঙ্কেল, অমুক ভাই-তমুক ভাই, অমুক বন্ধু-তমুক বন্ধু কাউকেই তখন পাশে পাওয়া যায় না।
প্রায় প্রত্যেকের জীবনেই একটা সংকটময় সময় থাকে। তোমার জীবনে সেই দুঃসময়টা যেদিন আসবে সেদিন থেকে তুমি পরিপূর্ণ ও সক্ষম মানুষ হতে শিখবে, সেদিন তুমি বুঝবে যে তুমি আসলে কে? অমুকের ছেলে বা মেয়ে, অমুকের ভাতিজা, অমুকের ভাই, অমুকের বন্ধু, ব্লা ব্লা— এসব কোনোটাই কাজে আসে না। তুমি আসলেই একা এবং তোমার নিজের পথ তোমাকে একাই গড়ে নিতে হবে। এক্ষেত্রে নিজের জ্ঞানবুদ্ধি, সাহস ও কর্মসক্ষমতাই একমাত্র সহায়ক হিসেবে কাজে আসে।
দেখা যায় ভদ্র ছেলেদের লাইফ অনেক কষ্টের হয়, কারণ তারা এই সত্যটা অনেক দেরিতে বুঝতে পারে। শৈশবে দুষ্টু থাকা ছেলেগুলো অল্প বয়সে ভুল করে ও এর দ্বারা বুঝে যায় তার কাছের মানুষগুলো আসলেই তার কতটা কাছের এবং সেই মাফিক লাইফ সাজিয়ে নিতে পারে। কিন্তু ভদ্র ছেলেগুলো এই বাস্তবতা অনুধাবন করতে শেখে অনেক দেরিতে।
এন্টিবায়োটিকের ডোজ কম্পিলিট না করলে দুর্বল হয়ে থেকে বেঁচে যাওয়া ভাইরাস ব্যাক্টেরিয়া যেমন পরিস্থিতি বুঝে নিজেদের গঠন চেঞ্জ করে ফেলে নিজেকে সেই পরিস্থিতিতে টিকে থাকার উপযোগী করে গড়ে তোলে, এই বইটি পড়লে সেইসব পরিস্থিতিতে থাকা তরুণরা যারা এখনও জানে না ভবিষ্যতে তাদের সাথে কী ঘটতে চলেছে সেইসব ছেলেমেয়েরাও নিজেদের প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করতে শিখবে ও নিজেকে সেই পরিস্থিতিতে টিকে থাকার জন্য সেইভাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।
তাই এরূপ বিভিন্ন কনজারভেটিভ ফ্যামিলির সন্তানদের লাইফের বিভিন্ন পরিস্থিতি গবেষণা করে তা থেকে উত্তরণের সম্ভাব্য পন্থা ও পদ্ধতি নিয়ে এই বইটি লেখা হয়েছে। বইটি সে সকল ছেলেমেয়েদের উপকারে এলে আমাদের এই পরিশ্রম ও প্রয়াস সার্থক হবে।
বইটি প্রি-অর্ডার করতে বইটির প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান 'টাইম পাবলিকেশন্স' এর ফেসবুক পেজের মেসেজ ইনবক্সে মেসেজ করুন। সম্পূর্ণ বই লেখা হলেই আমরা আপনাকে রিপ্লাই দিবো।
টাইম পাবলিকেশন্স | A Publication of Life Academy