আমি যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি সেটা ছিল ২০০৫ সাল। ওই সময়ে সারাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে একটা হইচই উঠলো যে এখন থেকে শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন করা হবে এবং সেইসাথে একটা বিকৃত তথ্য ছড়িয়ে পড়েছিল সেটা হলো— এখন থেকে আর সায়েন্স-আর্টস-কমার্স কিছু থাকবে না, সবাইকে সবকিছুই পড়তে হবে। আসলে বিষয়টা মোটেও সেরকম কিছু ছিল না, সরকারের পক্ষ থেকে যেটা করা হয়েছিল সেটা হলো ওই সময়ে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন করে Edexcel পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। আসলে আমরা বর্তমানেও যে শিক্ষাব্যবস্থায় পড়াশুনা করছি এই শিক্ষাব্যবস্থাটা প্রণয়ন করা হয়েছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বাংলাদেশে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছিল যেটার নাম ছিল কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন; এই শিক্ষা কমিশনের প্রধান ছিলেন কুদরত-ই-খুদা আর তার নেতৃত্বে সেই শিক্ষা কমিশন তখন তৎকালীন সময়ের ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার অনুকরণে বাংলাদেশে একটি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করলেন। পরবর্তীতে ব্রিটিশরা তাদের শিক্ষাপদ্ধতিকে চেঞ্জ করে যুগোপযোগী করে একটি ডেভেলপড শিক্ষাপদ্ধতি চালু করেছে যেটি Edexcel শিক্ষাপদ্ধতি নামে পরিচিত, ও লেভেল, এ লেভেল এসব হলো সেই ডেভেলপকৃত শিক্ষাপদ্ধতির মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক ভার্সন। কিন্তু বাংলাদেশ সেরূপ কিছু না করে ব্রিটিশদের সেই পুরাতন শিক্ষাব্যবস্থার ঐতিহ্যকে অদ্যাবধি ধরে রেখেছে।
প্রসঙ্গে ফিরে আসি, ২০০৫ সালে সেই হইচইটা উঠলো যে এখন থেকে শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন করা হবে এবং সায়েন্স-আর্টস-কমার্স এসব থাকবেনা। মানুষ এই কথা প্রচার করলেও সরকার কিন্তু আসলে এই কথা বলে নাই, সরকার বলেছিল Edexcel পদ্ধতি চালু করার সিদ্ধান্তের কথা; আর Edexcel সিস্টেমে সায়েন্স-আর্টস-কমার্স বলে কিছু থাকে না, এখানে কিছু বেসিক নীতিমালা আছে যাতে একজন শিক্ষার্থী কিছু সায়েন্স এর সাবজেক্ট কিছু আর্টস এর সাবজেক্ট এবং কিছু কমার্স এর সাবজেক্ট এভাবেও পড়তে পারে; এটা হলো একটা উন্মুক্ত চয়েসে পড়াশোনার পদ্ধতি। এই উন্মুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার নাম হলো Edexcel Education System; লিনাক্স যেমন কম্পিউটারের উন্মুক্ত অপারেটিং সিস্টেম তেমনি এটা ছিল একটি উন্মুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা।
কিন্তু বিষয়টাকে এভাবে ব্যাখ্যা করে উপস্থাপন না করে তখন বাংলাদেশে বলাবলি শুরু হলো যে, এখন থেকে আর সায়েন্স-আর্টস-কমার্স এসব কিছু থাকবে না, সবাইকে সবকিছু পড়তে হবে। এমনকি সেই সময়ে আমার একজন শ্রদ্ধেয় সিনিয়র শিক্ষকও ক্লাসে এসে বলেছিলেন যে, এরপর তোমাদের সময় থেকে সায়েন্স-আর্টস কমার্স বলে কিছু থাকবে না, সবাইকে সবকিছু পড়তে হবে।
এ থেকে এটাই বুঝা গেলো যে মানুষ তার পরিশ্রম কমানোর জন্য অথবা সময় বাঁচানোর জন্য কিংবা সে উদ্দেশ্যমূলকভাবে তথ্যকে বিকৃত করে যেটা খুবই বাজে একটা কাজ। কোনোকিছুকে গুছিয়ে বলতে হলে যদি বেশি সময়েরও প্রয়োজন হয় তবুও তথ্যকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা উচিৎ। উনি উনার কথাকে সংক্ষিপ্ত করার জন্য এই কাজটা করেছিলেন কিন্তু কথাকে সংক্ষিপ্ত করতে গিয়ে তিনি প্রকৃত জিনিসটাকে বিকৃত করে ফেললেন যা একটা ভুল তথ্যতে পরিণত হয়ে ছড়িয়ে গেলো।
উপরোক্ত বিষয়টি ছিল সময় সেভ করতে গিয়ে নিজের অজান্তে ঘটে যাওয়া তথ্যবিকৃতি। এছাড়াও অন্য একটা বিষয় আছে সেটা হলো মানুষ উদ্দেশ্যমূলকভাবেও তথ্যকে বিকৃত করে থাকে। সেটার একটা উদাহরণ এখন দিবো। ২০১৪, ২০১৫ কিংবা ২০১৬ সালে হবে বিষয়টা; সেটা হলো সে বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের "খ" ইউনিটের ভর্তিতে একটা নতুন নিয়ম সংযুক্ত করা হলো সেটা হলো দেশের যেসব শিক্ষার্থী ঢাবি "খ" ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ইংলিশ সাবজেক্ট পড়তে চায় তাদেরকে ভর্তি পরীক্ষায় 'বাংলা' অংশের পরিবর্তে Elective English এর উত্তর করতে হবে এবং তাতে পাশ করতে হবে। এর পূর্বে Elective English এর বিষয়টা ছিল যে, যারা বিদেশী শিক্ষার্থী হওয়ায় মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা পড়েনি কিংবা দেশের শিক্ষার্থী হয়েও দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় পড়াশুনা না করে Edxcual সিস্টেমে O Level, A Level এ পড়েছে তারাই শুধু 'বাংলা' অংশের পরিবর্তে Elective English এর উত্তর করবে। এক্ষেত্রে Elective English এর উত্তর করার জন্য ইলেকটিভ ইংলিশ নির্দেশক একটি বৃত্তও ভরাট করতে হয় এবং Elective English এর কলামে এমসিকিউ উত্তর করতে হয়। এক্ষেত্রে দেশের সাধারণ শিক্ষার্থীরা যে ইংলিশ এর উত্তর করবে প্রশ্নপত্রে সেটার প্রশ্নমালার উপরে General English লেখা থাকে আর ইলেকটিভ ইংলিশ এর প্রশ্নমালার উপরে Elective English লেখা থাকে।
সে বছর শিক্ষার্থীরা বাস্তববাদী হয়েছিল বলে তারা ভেবেছিল যে, আমি যদি English Literature পড়ার স্বপ্নে বাংলা অংশ বাদে Elective English এর উত্তর করি এবং তাতে পাশ করতে না পারি তাহলে আমার ইংলিশ পড়ার স্বপ্ন তো গেলোই ঢাবি "খ" ইউনিটের অন্য ৩৭ টা সাবজেক্ট এর অন্য কোনো একটা পড়ার স্বপ্নও গেলো। কারণ Elective English হলো Advanced English; এটির প্রশ্ন General English এর তুলনায় বেশ কঠিন তথা Advanced লেভেলের। ফলে পরীক্ষার্থীরা এই রিস্ক নিতে যায় নি। তাই তারা English Literature পড়ার স্বপ্ন না দেখে বরং নিরাপদভাবে স্বপ্ন পূরণের জন্য এই রিস্কি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে নি। মাত্র কয়েকজন প্রখর মেধাবী পরীক্ষার্থী English Literature পড়ার স্বপ্নে সাহস করে ঝুঁকি নিয়ে এতে অংশগ্রহণ করেছিল এবং তাদের মধ্যে দুইজন সফল হয়েছিল কিংবা হয়তো সেই দুইজনও বিদেশী কিংবা ও-লেভেল, এ-লেভল পড়া শিক্ষার্থী ছিল। ফলে মাত্র সেই দুইজন English Literature এ ভর্তির শর্ত পূরণে সফল হয়েছিল। অথচ সাংবাদিকরা এটা নিয়ে খবরের শিরোনাম করলো 'ঢাবি ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজিতে পাশ করলেন মাত্র দুইজন'!
বিষয়টা কিন্তু তা ছিল না, ইংলিশে কিন্তু পাশ করেছে শিক্ষার্থীরা। কারণ যারা এই ঝুঁকি নেয়নি, অন্যান্য সাবজেক্ট পড়তে চেয়েছে তারা বাংলা অংশের উত্তর করেছে এবং General English এর উত্তর করেছে, তারা Elective English এর উত্তরটাই করে নাই, পাশ-ফেলের প্রশ্ন তো পরের হিসাব। এক্ষেত্রে সংবাদের এরূপ শিরোনাম বিভ্রান্তিকর।
এক্ষেত্রে এটার শিরোনাম করা উচিৎ ছিল— 'ঢাবি ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তির শর্ত পূরণ করলেন মাত্র দুইজন'। সাংবাদিকরা পাঠক আকর্ষণের জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই বিভ্রান্তিকর শিরোনাম করেছিল।
সুতরাং আমরা বরাবরই দেখে থাকি যে, মানুষ তার আয়াস লাঘব করার জন্য কিংবা উদ্দেশ্যমূলকভাবে তথ্যকে বিকৃত করে থাকে। তাই আমাদের জীবনে কোনো একটি তথ্য হুটহাটভাবে পেয়েছি বলেই যে আমরা সেটা নিয়ে উত্তেজিত হয়ে যাবো তা না করে বরং আমাদেরকে সেই বিষয়ে সুক্ষভাবে অনুসন্ধান করে সেটির সঠিকতা, স্বচ্ছতা ও যথাযথতা নিরূপণ করে জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।