Friday, April 30, 2021

ভার্সিটি, বেকারত্ব এবং সামাজিক বাস্তবতা!


পাবলিক ভার্সিটিতে না পড়লে এবং লাইফে এরূপ নিঃস্ব অবস্থায় না পড়লে হয়তো এটা জানাই সম্ভব হতো না যে জগতে কত প্রকারের ধান্দাবাজ ও স্বার্থবাজ থাকতে পারে। আর এই স্বর্থবাদীতা চর্চার যুগে এসে আমরা ভুলেই গেছি যে সহানুভূতি, সাহায্য, ভালোবাসা, ইত্যাদি কিছু হৃদয় ঠান্ডা করা জিনিসের চর্চা কোনো একদিন মানব জাতির মাঝেও ছিল। এমনও একটি সময় হয়তো ছিল যখন একটা মানুষ আরেকটা মানুষের কষ্ট বুঝতো। আর আজকাল তো মানুষের দুর্বল পয়েন্টে আঘাত করে নিজের হীনস্বার্থ হাসিল করাকে মানুষ নিজের বুদ্ধিমত্তা মনে করে।

আমি কয়দিন ধরে একটা প্রবন্ধ লিখতে চেয়েছিলাম যে প্রবন্ধের নাম হবে "মৃত্যু"। মানুষের মৃত্যু কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয় The bath of a man is not any simple matter; মৃত্যু মানে একটা মানুষের চিরবিদায়। তার সাথে সকল ধরণের যোগাযোগ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়া। ইচ্ছে হলেও আর চলে যাওয়া মানুষটার সাথে দুটো কথা বলে উত্তপ্ত হৃদয় ঠান্ডা করার সুযোগ থাকে না; সারা পৃথিবী কিংবা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড খুঁজলেও তার মুখটা একবার দেখা সম্ভব হয় না; জিনিসটা খুবই করুণ, এতোটাই করুণ যে পৃথিবীতে এক প্রকারের পাখি আছে যে পাখিটার সঙ্গী/ সঙ্গীনী মারা গেলে তার সাথে যোগাযোগ করতে না পরার দুঃখ সইতে না পেরে কয়েক মিনিট পরে সেই কষ্টে সেও মারা যায়। কারও সাথে মনোমালিন্য থাকলেও মৃত্যুর পরে তার সাথে দুটো ভালো কথা বলার ইচ্ছে তার শত্রুরও হয়, কিন্তু তার আর কোনো উপায় থাকে না। তার সাথে সকল যোগাযোগই চিরতরে বন্ধ। অথচ এই করুণ জিনিসটারই একটা অসম্ভব সুন্দর সৌন্দর্য্য আছে, আর এই সৌন্দর্য্যের রূপলাবণ্য আধুনিক সময়ে এসে আরও বেড়ে গেছে। মৃত্যুর চেয়ে সুন্দর জিনিস জগতে আর কিছু নেই। কারণ মৃত্যুর পরই শুধু তোমার না থাকার অভাব অন্যরা বুঝতে পারবে, তোমার গুণগুলোও হাইলাইট হবে। বেঁচে থাকতে প্রতিনিয়ত শুধু দোষারোপ আর সমালোচনা ছাড়া আর কিছু পাবে না।

আধুনিক সময়ে এসে কে কার খবর রাখে। এই সময়ে স্বার্থ ছাড়া কেউ কারও জন্য এক বিন্দু পরিমাণ কোনো কিছুও করে না। সর্বোচ্চ মৃত্যুর পরে মানুষ যে সহানুভূতিটুকু দেখায় সেইটুকু যদি কোনো মৃত ব্যক্তি দেখতে পেতো তাহলে সেই হৃদয় শীতল করা অনুভূতিটুকু নিয়ে সে প্রভুর কাছে প্রার্থনা করতো প্রভু আমার আর কোনো আপসোস নেই, তোমার স্বর্গও আমি চাই না, শুধু আমার মনের এই শান্তিটা স্থায়ী করে দাও, আর কোনো দুঃখ আমার অন্তরে আসতে দিওনা, শুধু এটুকুই চাই তোমার কাছে।

পশুপাখির মৃত্যুর আর একটা আলাদা রকমের সৌন্দর্য্য আছে। মারা যাওয়া পশুপাখিগুলোর মৃতদেহ দেখে একটা আলাদা রকমের মায়া লাগে। আরও বেশি মায়া লাগে যখন দেখা যায় কোনো মৃত প্রাণির চোখ আধো আধো মৃদু দৃষ্টিতে ম্লান হয়ে চেয়ে থাকে; নিস্প্রভ একটি দৃষ্টি। এই দৃষ্টিতে কোনো হিংস্রতা নেই, কোনো রাগ নেই, কোনো লোভ নেই, কোনো নেগেটিভ কিছুর ছোঁয়া নেই। একদম কোমল শান্ত নির্মল একটি চাহনি। প্রাণির চঞ্চলতা হারিয়ে শান্ত দেহ একটি অনন্য সৌন্দর্য্যের আভা ছড়ায়।

মানুষের মৃত্যুর সৌন্দর্য যদি পশুপাখির মৃত্যুর সৌন্দর্যের মতো হতো তাহলে অনেক সুন্দর হতো। কিন্তু মানুষের মৃত্যুর সৌন্দর্যটা খুবই করুণ অসহ্য একটা সৌন্দর্য। কারণ মানুষের মৃত্যুর আবার দুইটা ধাপ আছে, বিশেষ করে পুরুষ মানুষের। অধিকাংশ পুরুষই দুই ধাপে মারা যায়। প্রথম ধাপে মানসিকভাবে, পরের ধাপে দৈহিক তথা চূড়ান্ত মৃত্যু।
প্রথম ধাপের মৃত্যুটা হয় পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে পড়ে কারও স্বার্থবাদের শিকার হয়ে কিংবা কারও খেলার পুতুল হওয়ায় মাধ্যমে। এই পর্যায়ে মানুষের সত্তার মৃত্যু হয়।

মানুষের সত্তার মৃত্যুর কোনো পরিসংখ্যান হয় না, শুধু এই মৃত্যুর কিছু ধরণ আলোচনা করা যায়।
এই পৃথিবীতে এমনও কিছু মানুষ আছে যাদের মন জয় করার চেষ্টা করাটা বোকামি। তাদের মন জয় করা দূরে থাক, তাদেরকে নিজের কলিজা রান্না করে খাওয়ালেও তারা বলবে 'রান্নায় লবন কম হয়েছে'; তুমি যে তোমার কলিজাটা খাওয়ালে সেটা তার চোখে পড়বে না, লবণ কম হওয়াটা চোখে পড়বে। এরূপ মানুষকে মন দিয়ে তার অবহেলার পঁচনে অনেকের মনের মৃত্যু হয়।

অনেকের সত্তার মৃত্যু হয় স্বার্থবাদীতার আঘাতে বিশ্বাস ভঙ্গ হওয়া থেকে। এই মৃত্যুর করুণ রূপটা অন্যকারো চোখে পড়ে না। এই মৃত্যুতে মৃত সত্তাকে স্মরণ করে দেহ একটি গান গেয়ে থাকে "নিছক একটা অ্যাম্বুলেন্স হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আমার ভেতরে এক মুমূর্ষু রোগী"।
সত্তার এই মৃত্যুর শিকার অধিকাংশই শিক্ষিত ছেলেরা হয়ে থাকে। আর এটা ঘটে থাকে পড়াশুনা শেষে বেকারত্বের দুর্দিনে এসে। করোনা মহামারীতে যতো মানুষের দৈহিক মৃত্যু হয়েছে তা চেয়ে অনেকগুন বেশি মানুষের সত্তার মৃত্যু ঘটেছে চাকরি হারিয়ে বেকার হওয়ার ফলে।

ধান্দাবাজ ছেলেরা মেয়েদেরকে এবং ধান্দাবাজ মেয়েরা ছেলেদের নিয়ে খেলে থাকে একথা সবার জানা, কিন্তু পিতামাতাও যে তার সন্তানকে নিয়ে খেলে থাকে এই অপ্রিয় সত্যটা বোঝা যায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে বেকার জীবনে এসে।
ছোটোবেলা পিতামাতা যেসব ছেলেদের সাথে মিশতে দিতো না, এবং বলতো তুই ভুলেও অমুক অমুক ছেলেদের মতো হতে পারবি না, দিব্যি রইল। এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো ফলাফল করে পাবলিকে চান্স নিয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করতে ৯-১০ বছর লাইফটা ত্যানা ত্যানা হয়ে যায়, হাতে বেশি টাকাপয়সাও জমা থাকে না। ওদিকে সেইসব ছেলেরা যাদের সাথে মিশতে নিষেধ করতো তারা এই কয় বছরে ব্যবসা করে কয়েক লক্ষ টাকা জমায় আর নিজ টাকায় বিয়েশাদীও করে ফেলে। তখন পড়াশুনা শেষে বেকার জীবনে এসে আবার বাবা-মায়েরা ওই ছেলেগুলোর যাদের সাথে মিশতে পর্যন্ত নিষেধ করতো তাদের উদাহরণ টেনে বলে, "তুই কী করলি জীবনে, অমুক অমুক দেখ টাকা জমাইছে, এই করছে, সেই করেছে, তোর পিছে আরও কীসের টাকা খরচ করা, এতোদিন যেটা করেছি সেটাই লস্"। এদিকে আত্মীয়স্বজন আবার আসবে জ্ঞান দিতে। হেল্প করতে কেউ আসবে না,আসবে জ্ঞান দিতে। কী জ্ঞান? সেটা হলো ওমুকে সাত/ আট বছর চাকরি করার পর এখন ৬০/ ৭০ হাজার টাকা বেতন পায়; তুমিও ওইসব চাকরিতে যোগ দাও। কী চাকরি? কোম্পানির এস আর এর চাকরি, আরও সহজ করে বললে ভ্যানে করে মালামাল নিয়ে বিভিন্ন দোকানে দোকানে সাপ্লাই দিয়ে বেড়ানো, এর বেতন শুরুতে ৭-৯ হাজার টাকা, শিক্ষাগত যোগ্যতা কোনোমতে ৩৩ নম্বর পেয়ে এসএসসি পাশ কিংবা কোনো কোনো কোম্পানির ক্ষেত্রে অষ্টম শ্রেণি পাশ। এখন কথা হলো তোমার ভালো পড়াশুনা করা এবং এই কয়েক বছরের তোমার প্রচেষ্টার কোনো মূল্যায়নই নেই। এই ধরণের একটা চাকরি যে আছে সেটা তুমি নিজেও ভালোকরেই জানো, কিন্তু তোমার এতো বছরের শ্রমের কোনো ভেল্যুই সেখানে নেই বলে সেই কষ্টে তুমি সেখানে যেতে পারো না। কিন্তু জ্ঞানদাতারা এই বিষয়টা এমনভাবে বলবে যে, তুমি এসব কিছু জানোই না, তারা তোমাকে এই তথ্যটা জানিয়ে দিয়ে তোমাকে অতি মহামূল্যবান একটা কিছু দিয়ে ফেলেছে। এই হলো বাস্তবতা। যখন তুমি তাদের এই জ্ঞানটা নিয়েও কাজে নামবে না, তখন তারা বলবে ভালো বুদ্ধি দিলাম আহাম্মক ছেলেটা শুনলো না। এবং তারা তোমার পিতামাতাকে এটাও বলবে যে, ঠিকই বলেছেন ভাই, আপনি আসলেই এতোদিন আপনার এই সন্তানের পিছে অহেতুক টাকা নষ্ট করেছেন। ওকে ভালো বুদ্ধি দিলাম, শুনতো না। যাহোক এতোদিন যা করেছেন তা তো আর ফেরৎ পাবেন না, আর নতুন করে টাকা খরচ করতে যাইয়েন না। ব্যস, আরও কী লাগে? এভাবে সাপোর্ট বন্ধ হয়ে যায় এবং স্বপ্নেরও মৃত্যু হয়।
ফলগাছে ফল না ধরলে সেই ফলগাছ যেমন কেটে ফেলা হয়, গাভীর দুধ না হলে সেই গাভী যেমন বিক্রি করে দেওয়া হয় তেমনি সন্তানের বেকারত্বের দুর্দিনে সন্তানকেও সেভাবে ছুঁড়ে ফেলা হয়।

এই হলো বাস্তবতা। পশুপাখির মৃত্যু হয় একভাবে এবং একবার, আর অধিকাংশ শিক্ষিত পুরুষের মৃত্যু হয় দুইভাবে এবং দুইবার। প্রথমে তার স্বপ্ন ও ভালোবাসা হারিয়ে তার নিজস্ব সত্তার মৃত্যু হয়, তারপর বাকি জীবন সে গাধার মতো একটা সত্তাহীন জীবনযাপন করে দৈহিকভাবে মৃত্যুবরণ করে।
বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন বলেছিলেন, ❝ অধিকাংশ মানুষই পঁচিশ বছর বয়সে মারা যায়, কিন্তু তাদেরকে সমাহিত করা হয় পঁচাত্তর বছর বয়সে ❞।

বেকারত্বের দুর্দিনে সবাই খারাপ ব্যবহার করে। মানুষ আঁড়চোখে তাকায়। আর এটা কোনো সাধারণ দুর্দিন নয়, এটা একটা মহাদুর্দিন। এই দুর্দিনে এসে এতো বেশি অবাক করার মতো সব ঘটনা ঘটে যেসব আগে কোনোদিন কল্পনাও করা যেতো না। এই সময়ে সেই বিখ্যাত বাগধারা 'অল্প শোকে কাতর, আর অধিক শোকে পাথর' এই ঘটনা জীবনে ঘটে থাকে। প্রথমদিকে অল্প আঘাতে কাতর হওয়া ছেলেটা পরে শান্ত হয়ে যায়, এর অর্থ এই নয় যে তার দুর্দিন কেটে গেছে; বরং সে অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছে।

এই সময়টাতে এসে পরিবার ও আত্মীয়রা ভয়াবহ রকমের স্বার্থবাদী আচরণ শুরু করে। দেখা যার যে একটা বেকার ছেলে কোনো একটা ছোট ব্যবসায় হাত দিয়েছে; সেটাতে কিছু টাকা ইনভেস্ট করলে ভালো লাভ হবে, কিন্তু ইনভেস্টের অভাবে প্রফিট খুবই কম। তখন পরিবার তাকে এরূপ কোনো সাহায্য করবে না যে এই নাও কিছু টাকা ইনভেস্ট করে ভালোমতো ব্যবসাটা করো, বরং বলবে 'তোর এই ব্যবসায় লাভ কই? এসব করে কাজ নাই তুই বাড়িতে কাজকাম কর'। কারণ বাড়িতে কাজ করলে পরিবারের লাভ। এখানে তাকে ছোট থেকে বড় হতে কেউ হেল্প করবে না বরং তার ক্ষুদ্রতা নিয়ে ভৎসনা ও সমালোচনা করে দাবিয়ে দেবে। জগতের সবখানেই স্বার্থের খেলা চলে, শুধু খেলার কলাকৌশলটা পরিবার, সমাজ, অফিস, ধর্মাধিষ্ঠান ও বিভিন্ন জায়গাভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে।

এই সময়ে এসে নিজের মাও অন্যের প্ররোচনায় পড়ে সৎ মা এ রূপান্তরিত হয়। মা বেঁচে না থাকলেও তার কবরের পাশে বসে থেকে একটা আপনত্বের শান্তি অনুভব করা যায়, কিন্তু বেকারত্বের দুর্দিনে যখন অন্য কারো প্ররোচনায় নিজের মা সৎ মা এ রূপান্তরিত হয় তখন যে কষ্টটা হয় সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। মা বেঁচে না থাকলেও তার কবর থাকে কিন্তু এরূপ একটা থেকেও না থাকা মাতৃহীনতার শূন্যতার হাহাকার অন্তরটাকে ঘুণপোকার মতো কুরে কুরে খায়। এই পরিস্থিতিতে যারা পড়েননি তারা এটা বুঝতে পারবেন না।

আমি যখন ইন্টারমিডিয়েটে রংপুরে থাকতাম তখন একটা স্বপ্নয়ম শান্তিতে ভরে থাকতো মনটা। তখন যে হাতে অনেক টাকা ছিল এমনটি নয়, তবে মনে নানাবিধ সুখানুভূতি ও শান্তি ছিল। কিন্তু এই স্বপ্নহীন, সহযোগিতাহীন একটা সময় এটাতে কোনো ভালো জিনিসও ভালো লাগে না। আমার পরিচিত দু'একজন সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে এবং আমিও ছেড়ে দিবো। কারণ এই পরিস্থিতিতে এসব ভালো লাগে না, বরং বেশি তেতো ও বিস্বাদ লাগে। ভোর সকালে যার বাবা মারা গেছে তার কাছে বহুদিনের প্রতিক্ষিত সাধের কাচ্চি বিরানি/ কোরমা পোলাও কিংবা চাইনিজ/ থাই ফুড দিয়ে সাজানো ব্রেকফাস্ট ভালো লাগবে না, বরং বিস্বাদ লাগবে, কিন্তু অন্যরা এটা বুঝবে না, যার বাবা মারা গেছে সেই শুধু বুঝবে। বাহিরে বের হলেই জ্ঞান দেওয়া লোকের অভাব হয় না কিন্তু হাতে ধরে এগিয়ে যেতে শিখিয়ে দেওয়ার লোক একজনও পাওয়া যায় না। বেকারত্বের সময়ে এসব লোকের ফাও জ্ঞান অসহ্য লাগে বলে সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়া বন্ধ করতে হয়।

আগে কয়েক বন্ধুতে মিলে ঝালমুড়ি কিনে খেয়ে যে শান্তি পেতাম এখন কোথাও এক প্যাকেট বিরানি খেয়েও সেই শান্তি পাই না, না জানি এই বিরানি খাওয়ানোর পিছনে কোন স্বার্থ লুকিয়ে আছে।