জীবনের একটি রূঢ় বাস্তবতা হলো, তোমার স্বপ্নের বিষয়ে কিংবা কোনো বৃহৎ কাজের উদ্যোগে তোমাকে পাম দেওয়ার ও প্রশংসা করার অনেক লোক থাকবে, আবার তুমি প্রত্যাশা মাফিক তা করতে না পারলে তোমার সমালোচনা করার লোকও থাকবে এবং সান্ত্বনা দেওয়ার লোকেরও অভাব হবে না। কিন্তু সেই কাজে তোমাকে হেল্প করার মতো, তোমার পাশে থাকার মতো একজনকেও পাবে না।
লাইফের এসব রূঢ় বাস্তবতা আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি এবং এখনও দেখছি।
এর কারণ কী জানেন? ফর্মালিটিস। এসব করতে তো আর কোনো প্রয়াস প্রয়োজন হয় না, শুধু অল্প একটু সময় দিলেই হয়। আর আমি এসব ফর্মালিটিস করি না বলে আমি অভদ্র মানুষ; আমি যা করি তা সারপূর্ণ মূল কাজটা করি, আর তা না পারলে এসব ফর্মালিটিস ধরণের অসার কাজ আমি করি না।
তুমি পারবে, এগিয়ে যাও, তোমার পাশে আছি এ সে হ্যান ত্যান— এসব ফর্মালিটিস কথাবার্তা যারা বলে প্রয়োজনের সময় হ্যাজাক লাইট লাগিয়েও তাদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না; এটাই বাস্তবতা।
আমি জীবনে বহু বৈচিত্রপূর্ণ কাজ করেছি ফলে মানুষের মেন্টালিটি ও ক্যারেক্টারের উপর অনেকটা পিএইচডি করে ফেলেছি। শুধু সার্টিফিকেটটা পাইনি, এই আর কি!
এমনও লোক আছে যারা কাছের মানুষ হয়ে বাঁশ দেয়, আবার দয়ালু-সাধু সেজে এসে সান্ত্বনাও দেয়।
আমি বিশ্বাস করি আপনি যদি কাউকে সাহায্য না করে থাকেন তবে তার কাজের গুণগত মান সম্পর্কে সমালোচনা করার অধিকার আপনার নাই। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল খারাপ খেললে আপনি তার সমালোচনা করতে পারেন, কারণ যে করের টাকার সরকারি কোষাগার থেকে তারা বেতন পায় সেখানে আপনিও কর দেন; সরকার কোনো অসংগতিপূর্ণ কাজ করলে আপনি তার সমালোচনা করতে পারেন; কারণ আপনিও রাষ্ট্রের জন্য কর দেন। কিন্তু কেউ ব্যক্তি উদ্যোগে কোনো সামাজিক কাজ করলে তার কাজের মান সম্পর্কে সমালোচনা করার অধিকার আপনার নাই। কেউ তার বাবার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে খেতে ডাকলে সেখানে খাবারের মান খারাপ হলে সে বিষয়ে সমালোচনা করার অধিকার আপনার নাই, আপনি খেলে খান, না খেলে উঠে যান।
অথচ, অধিকাংশ মানুষ অনধিকারচর্চামূলক পরচর্চা করে অমৃতরস আস্বাদনের মতো স্বাদ পেয়ে থাকেন।
'শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে'— তেমনি সমালোচনা করা তারই সাজে সাহায্য করে যে।
আরও একটি রূঢ় বাস্তবতা হলো, এ জগতের মানুষ সবাই স্বার্থবাদী এবং তারা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো স্বার্থবাদীতার বিভৎস রূপটাকে ঢেকে রাখার জন্য যুক্তি ব্যবহার করে।
জানতে চাও কীভাবে? তাহলে শুনো— অন্য মানুষের কথা পরেই থাক, বাবা-মা যাদেরকে আমরা নিঃস্বার্থ বলে জানি তাদের হিসাবটা ধরেই অঙ্ক মেলাই এসো। ধরে নাও কোনো দুজন সমবয়সী ছেলেমেয়ে প্রেমে পড়েছে; তারা বিয়ে করতে চায়। এখন কোনো পরিবারই এটা মেনে নেবে না; এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হলো— বিয়ে হলে তারা আর পড়াশুনায় ভালো করতে পারবে না, তাদের লাইফের উন্নতি ধ্বংস হয়ে যাবে। কী মনে হয়? আসলেই এটা কি বাস্তব যুক্তি? মোটেও না, এটা হলো স্বার্থবাদীতাকে ঢেকে রাখার যুক্তি আর সেটাই এখন ব্যাখ্যা করা যাক। ইন্টারমিডিয়েটে বিয়ে করেছিল কিংবা অনার্স লাইফে বিয়ে করেছিল এরূপ যাদেরকে আমি দেখেছি তাদের কাউকেই দেখি নাই যে বিয়ে করার কারণে তারা সফল হতে পারে নাই। এক্ষেত্রে ছেলের পরিবার এটা মেনে নিতে চায় না কারণ ছেলের বাবা-মা চায় ছেলে চাকরি করে টাকা জমিয়ে তারপর বিয়ে করুক, তাদেরকে যাতে টাকা খরচ করতে না হয়। অর্থাৎ কেউ কারও জন্য স্বার্থ ছাড়া হিসেবের বাইরে কোনো খরচ করতে চায় না, এটাই সত্য; সে বাবা-মা যেই হোক না কেনো। অন্যদিকে একজন অধ্যয়নরত ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে হলে লস্ কারণ একজন প্রতিষ্ঠিত ছেলের সাথে বিয়ে হলে তার থেকে যেসব পাওয়ার প্রত্যাশা থাকে এক্ষেত্রে সেসব থাকে না। অলরেডি প্রতিষ্ঠিত ছেলের সাথে বিয়ে হলে মাঝেমাঝেই এটাসেটা পাওয়া তো যায় অনেক কিছু পাওয়ার প্রত্যাশাও করা যায়।
তাই আমরা মেয়েকে সুখী দেখতে চাই বলে এই সম্পর্ক মেনে নিবো না, এটা হলো মেয়ের পরিবারের স্বার্থ ঢেকে রাখার যুক্তি। আর ছেলের পরিবারের যুক্তি হলো ছেলে তো আয় ইনকাম করে না, বউকে কী খাওয়াবে? পরিবারে যদি নিজের তিনটা মেয়ে থাকে তাদেরকে সারাজীবন তথা ১৮-২৪ বছর বয়স পর্যন্ত লালনপালন করা এবং বিয়ে দেওয়া সবই করা যার কিন্তু ছেলে বিয়ে করতে চাইলে অন্য একটা মেয়ে তাদের কাছে খুব বেশি হয়ে যায় তাকে ৩-৪ বছর সাপোর্ট দেওয়া যায় না, কারণ সেটা লস প্রজেক্ট; ছেলে সুখী হোক এই চাওয়াটা মনে আসে না, কিছুদিন একটু বেশি সম্পদ খরচ হবে সেই চিন্তা মাথায় ঢুকে অন্তরে কষ্ট বেজে ওঠে। আসল কথা হলো স্বার্থ। পিতামাতা সন্তানের মঙ্গলের জন্য সবকিছু করে, এটা ভুয়া কথা। তাদের স্বার্থ বজায় রাখতে যতটুকু করা দরকার ততটুকু তারা করে, তার বেশি এক বিন্দুও নয়। এই পৃথিবীতে কেউই স্বার্থের ঊর্ধ্বে নয়।
বঙ্গভঙ্গের ফলে ঢাকায় নতুন প্রদেশের রাজধানী হওয়ায় কলকাতার হিন্দুরা অফিস আদালতের ফি, আইন ব্যবসা ও তদসংশ্লিষ্ট আবাসিক হোটেল ব্যবসা, কর-রাজস্ব আদায় এবং ব্যবসাবাণিজ্যের একচেটিয়া সুবিধা হারায়— তাদের এই স্বার্থহানীই ছিল তাদের বঙ্গভঙ্গ বিরোধিতার মূল কারণ। কিন্তু সেকথা বলে তো আর আন্দোলন করা যায় না, তাই তারা যুক্তি দেখালো যে— বাংলা আমাদের মা, বাংলাকে ভাগ করা মানে বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ করা এবং এটি একটি পাপ কাজ।
অথচ, সেই হিন্দুরাই ভারত বিভাগের প্রাক্কালে ১৯৪৬ সালে অখণ্ড বাংলা গঠনের বিরোধিতা করে তা ভেস্তে দিয়েছিল; এই ছিল বাংলা মায়ের প্রতি ভক্তির নিদর্শন।
রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মনীতি এসব কোনো নীতিতেই নয়, এই পৃথিবী চলে একটা নীতির উপরে, সেটা হলো 'স্বার্থনীতি'। আর স্বার্থনীতির কুৎসিত রূপ ঢেকে রাখতে ব্যবহৃত হয় যুক্তি।
ব্যক্তিজীবনেও মানুষ এই কাজটাই করে থাকে।
কাছের মানুষ তথা অংশীদারীত্বের সম্পর্কযুক্ত এরূপ কাউকে আপন মনে করে তার কাছে কোনো বিষয়ে পরামর্শ চাইলে সে কখনও সুপরামর্শ দেয় না। বরং সে সুদূর ভবিষ্যৎ পর্যন্ত চিন্তা করে তার নিজ স্বার্থ অটুট রাখতে সে বিষয়ে যেভাবে পরামর্শ দেওয়া দরকার সেভাবে পরামর্শ দেয় এবং সে সম্পর্কিত উদাহরণ ও যুক্তি দিয়ে কনভিন্স করে ফেলে।
আমি সারাজীবন স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখে এসেছি এবং এখনও দেখছি। স্বার্থবাদীতার বিভৎস রূপটাকে আমি বেশ ভালো করে দেখেছি। যদিও মানুষজাতি সেটাকে যু্ক্তি নামক খোলস পরিয়ে ঢেকে রাখে তবুও তা আমার নজর এড়ায়নি। অনেক ধর্মগুরুকে দেখেছি নিজ স্বার্থের জন্য উল্টাপাল্টা ফতোয়াবাজি করতে। প্রার্থনালায়েও ধর্মগুরু কর্তৃক চাঁদাবাজি হতে দেখেছি।
এমনকি আমার মাতৃপক্ষের আত্মীয়স্বজনদের হীনস্বার্থবাদীতার নোংরা খেলায় বলির পাঠা হয়ে নিজের লাইফটাকে তছনছ লণ্ডভণ্ড হতে দেখেছি আমি।
সুতরাং আর কাকে সম্মান করবো আমি? আর কাকে ভালোবাসবো আমি? হু ইজ দ্যাট পার্সন?
আমিও যে মানুষ; আমারও যে দুঃখ-কষ্ট নামক অনুভূতিগুলো আছে সেটা তো কেউ মনেই করে না।
আমাকে কেয়ার করার কেউ নেই, আমাকে ভালোবাসার কেউ নেই, আমার পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। সো আই ডোন্ট কেয়ার এ্যানিওয়ান ইলস্।
© লেখক : মেহেদী হাসান।
বই : আই ডোন্ট কেয়ার (লেখা চলছে)।
লাইফের বিভিন্ন বিষয়ে উপদেশ-পরামর্শ পেতে লাইফ একাডেমির অ্যাডভইস ডেক্সে আসুন। আর Advice Desk এর ওয়েবসাইটের হোমপেজে যেতে এখানে—ক্লিক—করুন।
সুন্দর জীবনের জন্য পরামর্শ | Advice Desk